হযরত মুহাম্মদ (সা.) কিসের তৈরি?— কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ
হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানবজাতির সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, তিনি আল্লাহর সৃষ্টি এবং সকল মানুষের মতোই দেহ-মন নিয়ে গঠিত ছিলেন। তবে, তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে কিছু বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা কুরআন ও হাদিসে আলোচিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে তাঁর সৃষ্টির উৎস ও প্রকৃতি বিশদভাবে আলোচনা করব।
১. হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দেহগত সৃষ্টি
কুরআনের দৃষ্টিকোণ
কুরআনে বলা হয়েছে যে, সমস্ত মানবজাতি মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। যেমন,
আল্লাহ বলেন:
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الإِنسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ“আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি নির্যাস থেকে, যা কাদামাটির নির্যাস।” (সুরা মু’মিনুন: ১২)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, সকল মানুষের মতোই নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর শারীরিক গঠনও মাটি থেকে সৃষ্টি।
আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে:
خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ"তিনি তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর বললেন 'হও', ফলে সে হয়ে গেল।" (সুরা আলে ইমরান: ৫৯)
এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ও অন্যান্য মানবের মতোই আল্লাহর নির্দেশে মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছেন।
হাদিসের দৃষ্টিকোণ
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও বলেছেন যে, তিনি মানুষের মতোই একজন মানুষ।
তিনি বলেন:
"আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমি খেতে পাই যেমন তোমরা খাও, আমি ঘুমাই যেমন তোমরা ঘুমাও।" (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০০৭)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, দেহগতভাবে তিনি অন্য সাধারণ মানুষের মতোই ছিলেন।
২. নূরের সৃষ্টি প্রসঙ্গে
কিছু হাদিসে এসেছে যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নূর (আলো) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
হাদিসের আলোকে
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) একবার নবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তায়ালা কোন জিনিস থেকে আপনার সৃষ্টি করেছেন?”
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন:
"আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন এবং সেটি থেকে সকল সৃষ্টির সূচনা করেছেন।" (মুসনাদে আবু ইয়ালা, বাইহাকি)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, নবী করিম (সা.)-এর রুহানী সত্ত্বা আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যতা
কুরআনে বলা হয়েছে:
قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ"নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নূর এবং এক সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।" (সুরা মায়েদা: ১৫)
এখানে "নূর" বলতে অনেক ব্যাখ্যাকারী কুরআনকেই বুঝিয়েছেন, আবার কেউ কেউ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে বুঝিয়েছেন।
৩. রাসুল (সা.) সৃষ্টির সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষত্ব
অনেক হাদিসে এসেছে যে, নবী মুহাম্মদ (সা.) হলেন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বপ্রথম, অথচ তিনি দুনিয়াতে এসেছেন সর্বশেষ নবী হিসেবে।
রাসুল (সা.) বলেন:
"আমি তখন নবী ছিলাম, যখন আদম (আ.) কাদা-মাটির মধ্যে ছিলেন।" (তিরমিজি, হাদিস: ৩৬০৯)
এর মানে, তাঁর নবুওয়াতের পরিকল্পনা এবং মর্যাদা আল্লাহ পূর্বেই স্থির করেছিলেন, যদিও তিনি মানবজাতির শেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে এসেছেন।
৪. রাসুল (সা.)-এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য
যদিও নবী মুহাম্মদ (সা.) একজন মানব, তবুও তিনি সাধারণ মানুষের মতো ছিলেন না। তার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল, যেমন:
(ক) গুনাহ থেকে মুক্ত
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ . إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ"তিনি নিজের ইচ্ছা থেকে কিছু বলেন না, বরং যা কিছু বলেন তা ওহী (আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বার্তা)।" (সুরা নাজম: ৩-৪)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, তিনি গুনাহের ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং সর্বদা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরিচালিত হতেন।
(খ) চেহারার সৌন্দর্য
হাদিসে এসেছে,
"আমি কোনো ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মতো সুন্দর দেখিনি। যেন সূর্য তাঁর চেহারায় প্রতিফলিত হত।" (তিরমিজি, শামায়েলে মুহাম্মদিয়া)
৫. উপসংহার
নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মাটি থেকে সৃষ্ট একজন মানুষ, কিন্তু তাঁর রুহানী সত্ত্বা আল্লাহর বিশেষ আলো (নূর)-এর অংশ। কুরআন ও হাদিসের আলোকে তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়—একটি হলো তিনি সাধারণ মানুষের মতোই মাটি থেকে সৃষ্টি, এবং অপরটি হলো তিনি আল্লাহর বিশেষ নূর থেকে সৃষ্টি। তবে ইসলামের মূল আকীদা অনুযায়ী, তিনি একজন মানুষ এবং নবী ছিলেন, আল্লাহর দাস ছিলেন এবং আল্লাহর কোনো শরীক বা অংশীদার ছিলেন না।
এটাই ইসলামের দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সৃষ্টি সম্পর্কে মূল ব্যাখ্যা।
0 মন্তব্যসমূহ